নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
কবি কুসুম কুমারি দাস যে ভবনা নিয়ে লিখেছিলেন ”আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে” সেই ভাবনার বাস্তব রুপ রংপুরের দুই সহোদর তানবীর ও তৌহিদ হোসেন। পৃথিবী নামক সময়ের মহাসমুদ্রে জীবন নামের ঢেউকে যারা দুলিয়েছেন পরতে পরতে। দীর্ঘ সংগ্রাম, চেষ্টা, অধ্যাবসায় আর সততার বলে বলিয়ান হয়ে তারা আজ প্রতিষ্ঠিত। ব্যবসায়ীক সফলতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানবসেবা দেশপ্রেম সবকিছুর মিশেলে এই দুইভাই যেনো কবি নজরুল কবিতার সেই বীর যার ‘চির উন্নত মমশীর’।
চলতি অর্থবছরের মহানগর পর্যায়ে তরুণ ক্যাটাগরিতে সেরা করদাতা হয়েছেন তানবীর হোসেন আশরাফি ও তৌহিদ হোসেন। তানবীর আশরাফী প্রথমবার হলেও তৌহিদ হোসেনের জন্য এই রাষ্ট্রীয় সম্মান টানা পঞ্চম বার। তাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে বদলে যাওয়া রঙের স্পর্শে আজকের রঙিন অর্জনের অতীতটা বেশ ফ্যাকাসে। শৈশব কৈশোরে জীবনে ভোরবেলায় রক্ত ঘাম একাকার করে লড়ে যাওয়া দুই ভাইয়ের জীবনের গল্পটা কিছুটা ভিন্ন ও ব্যতিক্রম। সেই ব্যতিক্রম গল্প আর সংগ্রামের অধ্যায়টি বেশ প্রেরণাদায়ক সঙ্গে হৃদয়স্পর্ষীও বটে।
রংপুর অঞ্চলের এক সম্ভ্রান্ত মুসুলিম ব্যবসায়িক পরিবারে ১৯৮৪ সালের ৮ ডিসেম্বর তানবীর হোসেন ও ১৯৮৭ সালের ১০ ই মে জন্ম গ্রহন করেন তৌহিদ হোসেন। রংপুরের জুম্মা পড়ার বাসায় সাফায়েত হোসেন ও ইশরাত বেগম দম্পত্বির কোল আলোকিত করে জন্ম নেয়া দুই ভাই বেড়ে ওঠেন শহুরে পরিবেশে ধর্মীয় ও পারিবারীক অনুশাসনে। একান্ত আলাপচারিতা মুখর সন্ধায় তানবীর আশরাফি জানান তাদের পরিবারের হাতেই তাদের শিক্ষা ও সৎতার ভীত গড়ে উঠেছে। তারই কন্ঠে উঠে এলো তাদের পরিবারের গৌরোবজ্জল অতীতের আলাপ। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল ১০ বছর সাফায়েত হোসেন ছিলেন রংপুর অঞ্চলের সব চেয়ে বড় ইলেকট্রনিক্স ও মোটরসাইকেল ব্যবসায়ি। স্টেশন রোডের হোসেন ব্রাদার্স ইলেক্ট্রনিক্সের নাম তখন রংপুর জুড়ে। সেই সুবাদেই পারিবারিক আর্থিক আভিজাত্যে বড় হতে থাকেন তানবীর ও তৌহিদ।
সেই ৯০ দশকে রংপুরের বাইরেও সাফায়েত হোসেনের বেশ কয়েকটি শাখা। এরই মধ্যে সৈয়দপুর এবং জলঢাকা ব্রাঞ্চের ম্যানেজাররা পুরো ব্যবসায় নামিয়ে দেন ধ্বস। সেই ধ্বসে একেবারেই পুঁজি হারিয়ে ফেলেন সাফায়েত হোসেন। শুরু হয় তানবীর ও তৌহিদদের পরিবারে আর্থিক দৈন্যদশা। ব্যবসায়িক লোকসানের টেনশনেই সাফায়েত হোসেন ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ব্রেন স্টোক করে ভর্তি হন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
৭ দিন চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসেন বাসায়। কিন্তু তাকে তাড়া করে বেড়ায় লোকসানের বিষয়টি। আবারও ১৭ দিনের মাথায় তিনি ব্রেন স্টোক করেন। এরপর শয্যাশয়ি হন। অর্থনৈতিক ভাবে আর উঠে দাড়াতে না পারলেও এখনো অসুস্থ শরীর নিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় ৫ সন্তানসহ সাফায়াতের সংসার চলতে থাকে দোকান থেকে পাওয়া ভাড়ার টাকায়। খুব দৈন্যদশার মধ্যে চলতে থাকে সংসার।
ব্যবসায়িক লোকসানের কারনে সব ফিঁকে হয়ে যায় পরিবারটির। একরকম বাধ্য হয়েই তখনি জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন দুই ভাই।
জীবনের চড়াই উৎরাই এর যেখানে শুরু সেখানেই আরম্ভ হয় তানবীর ও তৌহিদের ব্যবসায়ীক পথচলা। শুরুটা ফুফা নাইয়ার আজম এর হাতধরে যিনি ছিলেন একজন পরিচিত মোটর সাইকেল পার্টস ব্যবসায়ী। প্রাথমিকের পাঠ শেষ হতেই মা ইশরাত বেগমের অনুরোধে ফুফা নাইয়ার আজম প্রথমে দ্বীমত করলেও পরবর্তীতে পার্টস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করেন তানবীর ও তৌহিদ হোসেনকে।
সেই ছোট বয়সেই ব্যবসার জটিল হিসাব না বুঝায় ফুফার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার প্রতিটি উপজেলায় ফুফার সাথে যাওয়াই ছিল তানবীর ও তৌহিদের কাজ। বিনিময়ে দৈনিক এক ভাইয়ের ভাগে জুটতো ১০০ টাকা করে। পালাক্রমে সেই কাজ দুইভাই করেছেন অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত। একদিকে ফেরী করে পার্টস বিক্রী অন্যদিকে পড়ালেখাও চলতে থাকলো সমানতালে।
অস্টম শ্রেনিতে উঠার পর ফুফার কাছে যন্ত্রাংশের দাম কেটে নিয়ে বিক্রি শুরু করেন তানবীর ও তৌহিদ। ১৩ হাজার টাকার যন্ত্রাংশ দর কেটে শুরু হয় প্রথম দিনের ব্যবসা। সেই যন্ত্রাংশ মিঠাপুকুর, শঠিবাড়ি ও বড় দরগায় বিক্রি করে প্রথম দিনে ১ হাজার ১৮০ টাকা মুনাফা করে মায়ের হাতে তুলে দেন দুজনে। এভাবে এক বছর ফুফার কাছ থেকে যন্ত্রাংশ ক্রয় করে বিক্রি করে বছর ঘুরতেই পুঁজি দাড়ায় দেড় লাখ টাকায়।
এরপর ফুফার সহযোগিতায় যশোর ও ঢাকা থেকে মহাজনদের কাছ থেকে মাল ক্রয় করে এনে জেলায় জেলায় উপজেলায় উপজেলায় ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন জীবনযুদ্ধে অটল ও অবিচল দুই যোদ্ধা।
একান্ত আলাপে তানবীর আর তৌহিদ হয়ে উঠলেন আবেগআপ্লুপ। হৃদয়ের কোঠরে জমাটবাঁধা না বলা কথাহগুলো যেনো গুমরে উঠলো ছাঁইচাপা আগুনের মত। একে একে দুই ভাই বললেন, তাদের জীবনের অজস্র সংগ্রাম থেকে গুটিকয়েক ঘটনা। যেগুলো এখনো নাড়া দেয়ে তাদেরর স্মৃতীর মনিকোঠায়।
তৌহিদ হোসেন জানান, একদিন দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে মালামাল বিক্রি করে সৈয়দপুরের বাস ধরার জন্য স্ট্যান্ডে আসি। দেখি শেষ গাড়িটিও ছেড়ে দিচ্ছে।
তখন এক মন ওজনের মালামালের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে বাসের পেছনের ছাদের উপরে ওঠার সিড়িতে লাফিয়ে উঠি। ওই বাসটিতে ছাদেও জায়গা ছিল না। খাচা ভর্তি মাছ ছিল। বাস রাস্তায় গিয়ে ব্রেক কষলে সেই মাছের পানি মাথাসহ সারা শরীরে পরে ভিজে যায়। এভাবে বার বার ভিজে ভিজে সৈয়দপুর আসি।
সেখান থেকে রংপুর আসার জন্য আরেকটি বাসে উঠি। কিন্তু আমার শরীরের মাছের আঁশটে গন্ধ পুরো বাসে ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রীরা আপত্তি করলে তারাগঞ্জে এসে সুপারভাইজার আমাকে নামিয়ে দেয়। বাস থেকে নামিয়ে দেয়ার পর সেদিন মাঝ পথে খুব কেঁদেছিলাম।
আলাপের সন্ধায় তানবীর আশরাফিও খুলে বসেন তার স্মৃতীর থলি। গুমরে ওঠা হৃদয়ের আয়না হয়ে ছলছল করছিল তার চোখ। বলছিলেন তার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগের রাতের ঘটনা।২০০১ সালে আমি ছিলাম কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী। পার্টস কিনতে গিয়েছিলাম যশোরে। ইচ্ছে ছিল দিনের মধ্যে ফিরে এসে রাতভর পড়াশোনা রিভিশন দিয়ে পরদিন যাব পরীক্ষাকেন্দ্রে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সেদিন একে এক সবগুলো বাস মিস করে আর ফের